ইমদাদুল হক যুবায়ের।। বর্তমান বিশ্বের সর্বাধিক আলোচিত বিষয়সমূহের অন্যতমও হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। কেবল আন্তর্জাতিক পরিসরে নয়, বাংলাদেশেও স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের যে কোনো নীতি নির্ধারণী আলোচনায় বা সমস্যা সমাধানে নারীর ক্ষমতায়নকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ক্ষমতায়ন ব্যক্তির ভেতরে আত্মবিশ্বাস দৃঢ় করে, পরমুখাপেক্ষী না হয়ে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করে। এভাবে একজন নারী বা পুরুষ যখন জীবন জিজ্ঞাসার মতামত গ্রহণে ক্ষমতার অধিকারী হয়, তখন মনে করা হয় তার ক্ষমতায়ন হয়েছে।
‘ক্ষমতায়ন’ সম্পর্কে ড. শেখ আমজাদ হোসেন বলেন- “ক্ষমতায়ন হচ্ছে নারী ও পুরুষের নিজ নিজ জীবনধারার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় নিজস্ব কর্মসূচী নির্ধারণ, দক্ষতা অর্জন, সমস্যা সমাধান, আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরশীলতার উন্নয়ন।” (শেখ আমজাদ হোসেন, জেন্ডার স্টাডিজ, পৃ. ২৭)
‘ক্ষমতায়ন’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন- Paulo Faire (1973) ; যে শব্দটি আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে একটি জনপ্রিয় পরিভাষা হয়ে উঠে এবং তা Welfare, Development, Participation, Control, Access, Conscientisation ইত্যাদি শব্দগুলোর স্থলাভিষিক্ত হয়। এ সম্পর্কে Chandra বলেন-Empowerment in the simplest form means the manifestation of redistribution of power that challenges patriarchal ideology and the male dominance. “সহজ অর্থে- ক্ষমতায়ন বলতে পিতৃতান্ত্রিক আদর্শবাদ ও পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্বের বাহিরে ক্ষমতার নতুন বিভাজনের প্রকাশকে বুঝায়।” (Bettany The Encyclopaedia Britanica)
ক্ষমতায়ন একটি সক্রিয়, বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া যা নারীদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের পূর্ণ পরিচয় বহনে সাহায্য করে। ক্ষমতা কোনো দ্রব্য কিংবা লক্ষ্য নয় যে, এটাকে বহন বা পরিত্যাগ করা যাবে। ক্ষমতা অর্জন করতে হয় এবং এটার জন্য প্রয়োজন ক্ষমতার চর্চা বজায় রাখা এবং সংরক্ষণ করা। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অগ্রাধিকারকে নারীর ক্ষমতায়ন বোঝায়।
দক্ষিণ এশিয়াতে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলকভাবে তিনটি দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। যথা: Integrated Development, Economic Development and Awareness raising (Sushama, 1998:50) সমন্বিত উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সচেতনতা বৃদ্ধি। “সমন্বিত উন্নয়ন তত্তে¡র মূল দর্শন হলো- পরিবার ও সামাজিক উন্নয়নের চাবিকাঠি নারী উন্নয়ন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন তত্তে¡র মূল বক্তব্য হলো- যে বিষয়গুলো নারীর অধিনস্ততা সৃষ্টি করে সে বিষয়গুলো সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। (Women, environment and development: Dissertations, Page: 1549.)
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- স্বাধীন বাংলাদেশে নারীর পূর্ণ ক্ষমতা বা অধিকার কি নিশ্চিত হচ্ছে? নারীদের প্রতি নির্যাতন, বৈষম্য কি সামান্য পরিমাণ হৃাস পেয়েছে? বাংলাদেশ এখনও নারীর পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি। এখনও পারেনি নারী নির্যাতন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে। বরং নারীর প্রতি সহিংসতা আরও মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশজুড়ে নারী হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন ক্রমশ: বেড়েই চলেছে। নারী পরিস্থিতির উন্নতি না হয়ে ক্রমশ: অবনতিই হচ্ছে। নারীর প্রতি যৌন লালসার হিংসা থেকে বাদ যাচ্ছে না নারী শিশুরাও। নারী আজ কর্মস্থলে নিরাপদ নয়। তাই বাংলাদেশে যতটুকু নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে তাতে এখনও নারীমুক্তি আসেনি। শুধু নারীর ক্ষমতায়ন নারীর মুক্তি নিয়ে আসবে না। নারীর মুক্তির জন্য মানসিকতার পরিবর্তন। পুরুষ যতদিন না নারীকে তার সহযোগী ভাবতে শিখবে, যতদিন না নারীকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে মেনে নিবে ততদিন এ সমস্যার সমাধান হবে না।
ক্ষমতা দু’ধরনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিহ্নিত হয়; অর্থনৈতিক শক্তির ক্ষমতা ও জ্ঞান শক্তির ক্ষমতা। তাই এই দু’শক্তির মাঝে সেতু বন্ধন হলে নারী বা পুরুষ ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়। ক্ষমতা ও দায়িত্ব পাশাপাশি চলে। নারী ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে তার উপর অনেক দায়িত্ব অর্পিত হয়। বাংলাদেশের নারী সমাজ তাদের নিজেদের ঐতিহ্য সংরক্ষণে ক্ষমতাবান। তারা পরিবার ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে, কিন্তু নতুন কোনো চিন্তা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনা। কথাটা এটাই প্রমান করে যে, বাংলাদেশে পারিবারিক জীবনে নারীর ক্ষমতায়ন আক্ষরিক অর্থে হয়নি। পুরুষের মত আমাদের নারী নেত্রীরা সংসদে জাতীয় সমস্যা সমাধানে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। এদিক থেকে বিচার করলে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের নারীরা ক্ষমতাপ্রাপ্ত।
আমাদের দেশে নারী ক্ষমতায়নে নারী শিক্ষায় অগ্রগতি হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী-পুরুষের সমান প্রবেশাধিকার আছে। লেখাপড়ার ফলাফল দেখলে নারীর গৌরবোজ্জল ফলাফলই চোখে পড়ে। কিন্তু তা সত্বেও সামাজিকভাবে বেড়ে উঠার স্তরগুলোতে নারীকে ‘নারী’ অর্থাৎ দূর্বল জেন্ডার রুপেই এগিয়ে যেতে হয়। আজকাল পরিবারে নারীর সফলতা এসেছে বলা চলে। তবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারনে সমাজের গতিতে চলার অভ্যাস রপ্ত থাকাটা নারীকে সামাজিক স্বীকৃত পাবার পক্ষে সহায়তা করবে।
নারীর সাহসী ভূমিকার কথা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়কাল থেকে শোনা যাচ্ছে। অনেক নারী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন অথবা দেশের ভিতরে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোদ্ধা ও সাহায্যকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সংবিধানের ভাষার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নারী ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছে বা সমান অধিকার লাভ করলেও সামাজিক অবকাঠামো পরিবর্তনের শ্লথগতি এ ক্ষমতাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না। শিক্ষার হার বৃদ্ধি সত্বেও আইন করে নারীর বাল্য বিবাহ ও যৌতুক প্রথা বন্ধ করতে হচ্ছে, ১৮ বছর বয়সের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়া বন্ধ হয়নি, যৌতুকের জন্য লাঞ্চনা ও মৃত্যুবরণ এখনো চলছে। এ অন্যায় প্রতিরোধ করার জন্য পরিবার থেকে নারীর প্রতি অবলাসুলভ মনোভাব পাল্টাতে হবে। নারীকে ক্ষমতা দিলে একজন নারী স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে পরিবার ও সমাজকে স্বাস্থ্যবান করে তুলতে পারে এবং সুখী সমৃদ্ধ জীবনের কথা ভাবতে পারে। বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়ন বর্তমানে এ পথ ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে নারী সহিংসতা ও নারী নির্যাতন বৃদ্ধির হার আশংকাজনক। সমাজে নারীর প্রতি গড়ে উঠা দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধগুলোও সুস্পষ্ট। তাই বিদ্যমান সংকট নিরসনে যৌক্তিক বিবেচনা করেই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সমাজের প্রচলিত বিশ্বাস ও ঐতিহ্যকে বিবেচনায় না এনে কোনো প্রক্রিয়াতেই নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। সংস্কার বা পরিবর্তন হঠাৎ করে জোর করে চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। তাই ধীরে ধীরৈ কৌশলে অত্যন্ত সু²ভাবে, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। যাতে কারো প্রতি সুবিচার করতে যেয়ে কারও প্রতি অবিচার না হয়ে পড়ে বা নিজস্ব স্বকীয়তা, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় হুমকির মুখে না পড়ে। এজন্য মানসিক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে।
আলোচনার প্রান্ত টিকায় এসে বলতে পারি যে, জগৎ সংসারে নারীকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। নিজের সন্তানকে গর্ভে ধারণ এবং জন্ম দিয়ে পৃথিবীর আলো দেখানোর মাধ্যমে একজন ‘মা’ নারী হিসেবে জীবনের সার্থকতা লাভ করে। এছাড়া স্ত্রী, বোন, কন্যাসহ মর্যাদাপূর্ণ সব সম্পর্কের বাঁধনে নারীরা সমাজের সাথে আবদ্ধ। তারা সমাজের অর্ধেক অংশ। তাদের প্রতিভা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা বিকাশের সুযোগ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের জন্য অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য। নারীর সহিংসতা, নির্যাতন, নিপীড়ন, বঞ্চনা বৈষম্য এগুলো মোটেই কাম্য নয়। সত্যিকারার্থে নারীকে যথার্থ মূল্যায়ন না করে সুন্দর শান্তিময় সমাজ গঠনে কার্যকর ভূমিকা আশা করাটাও ঠিক হবে না। তাই অচিরেই নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়নকে গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে, এক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি না করে যৌক্তিক পন্থায় সবাই এগিয়ে আসুক এটাই আহ্বান।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও শিক্ষক, জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, সিলেট।
প্রকাশক ও সম্পাদক : মোঃ জাহাঙ্গীর আলম রাজু
হেড অফিস : প্রস্তাবিত (১ম তলা),৯৮, নয়াপল্টন,ঢাকা-১০০০
বানিজ্যিক এলাকা: বাইপাইল আশুলিয়া,সাভার,ঢাকা।
মফস্বল কার্যালয়: মেইন রোড (২য় তলা),কেশবপুর,যশোর।
নিউজ-মেইল: dailyamaderbd24@gmail.com
নিউজ রুমঃ রাজু:- ০১৭১১-১৩৯৪২০
আমাদেরবাংলাদেশ. ডট কম