ষ্টাফ রিপোর্টার:
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সারাদেশ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সে সময় সরকারির বিভিন্ন দফতর থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত ও গণপরিবহন যে আইনের তোয়াক্কা না করেই সড়কে চলছে তা শিক্ষার্থীরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। আন্দোলনের মুখে দোষী ব্যক্তিরা আইন মেনে চলার অঙ্গীকার করলেও আন্দোলন পরবর্তী অবস্থা আগের মতোই। চলমান ‘ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষে’ এ চিত্র আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পরিবহন চালক ও পথচারীরা মানছেন না ট্রাফিক আইন। দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হলেও, সচেতনতার অভাবে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরার কোনও সুখবর নেই।
ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ, জনসচেতনতা এবং সড়কে ট্রাফিক শৃঙ্খলা আনার লক্ষ্যে গত ১৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় ‘ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ’। এই কার্যক্রম চলবে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। ট্রাফিক পক্ষের গত ৯ দিন রাজধানী জুড়ে ট্রাফিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ৪৬ হাজার ৪৪টি মামলা দায়ের করেছে ট্রাফিক পুলিশ। জরিমানা করা হয়েছে ২ কোটি ২৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫০ টাকা। মামলা সবচেয়ে বেশি হয়েছে মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে। মোট ২০ হাজার ৯৯০টি মামলা ছাড়াও ৯৭০টি মোটরসাইকেল আটক করা হয়েছে। এছাড়া উল্টোপথে চলাচলের অপরাধে ৮ হাজার ২০৪টি মামলা হয়। এসব মামলায় মোট ২ কোটি ২৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫০ টাকা জরিমানাও করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ।
এছাড়াও সড়কে অভিযানকালে ২০৭টি গাড়ি ডাম্পিং ও ৬ হাজার ১৮৫টি গাড়ি রেকার করা হয়। হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের দায়ে ৯৫২টি, হুটার ও বিকনলাইট ব্যবহারের কারণে ৬০টি, স্টিকার ব্যবহারের জন্য ৮টি এবং মাইক্রোবাসে কালো গ্লাস ব্যবহারে ১১৭টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইলফোনে কথা বলার অপরাধে ১৪৯ জন চালকের বিরুদ্ধেও মামলা দেওয়া হয়।
এ চিত্র দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাফিক পক্ষে কেবল মামলা দেওয়াই সার হচ্ছে। সড়কে ট্রাফিক শৃঙ্খলা ফেরাতে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এরজন্য সকল পর্যায়ে ট্রাফিক সচেতনতামূলক জোরালো প্রচারণা চালাতে হবে। আইন ভঙ্গকারীর জরিমানার হার দ্বিগুণ করতে হবে। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করলেই কেবল সড়কে শৃঙ্খলা ফিরতে পারে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘সড়কে আইন অমান্য করার দায়ে মানুষ (চালক, পথচারী) যখন ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঠিক তখনই তারা আইন মানতে বাধ্য হবে। শুধু চালকদেরই নয়, পথচারীদেরও দোষ আছে। তারাও আইন মানে না। তবে পথচারীদের বিষয়ে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
জোরালো প্রচারণার কোনও বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এতদিনেও সড়কে কেউ আইন মেনে চলেনি। এখন মানুষকে আইন মানাতে হলে কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। আমার সাজেশন হচ্ছে- তিনমাস দেশের সকল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে এবং বিভিন্ন কমিউনিটিতে গিয়ে ট্রাফিক সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। তিনমাস পর কেউ যদি ট্রাফিক আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করে তবে তার এবং তার কর্মরত প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
সড়কে দায়িত্ব পালনকারী ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বলছেন, সড়কে যারাই ট্রাফিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছে তাদেরকেই আমরা মামলা দিচ্ছি। কিন্তু এরপরও চালক-পথচারীরা আইন মানছেন না। রাজধানীর বিভিন্ন সিগন্যালে ট্রাফিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মাইকিং করে বলা হচ্ছে এবং বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাফিক সদস্যরা আইন মেনে চলার অনুরোধও করছেন। কিন্তু মনে হচ্ছে মানুষের মধ্যে আইন মানার প্রবণতা যেন কমে গেছে।
বুধবার (২৩ জানুয়ারি) সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর উত্তরা হাউজবিল্ডিং এলাকায় ফুটওভার ব্রিজ থাকার পরও পথচারীরা ঝুঁকি নিয়ে সড়ক পারাপার হচ্ছেন। গণপরিবহণগুলো চলন্ত অবস্থায় দরজা খোলা রাখছে। অপরদিকে উত্তরা আজমপুর এলাকায় ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে সড়কের আইল্যান্ড টপকে পথচারীদের পার হতে দেখা গেছে। সেই সঙ্গে সড়কের মাঝখানে গণপরিবহণ থামিয়ে যাত্রী উঠা-নামাও চলছে।
হাউজবিল্ডিং এলাকায় ঝুঁকি নিয়ে সড়ক পার হওয়া আশরাফুল নামে একজন পথচারীর সঙ্গে কথা হয় । এ সময় আশরাফুল ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করার কারণ জানান। তিনি বলেন, ‘হাউজবিল্ডিংয়ের ফুটওভার ব্রিজটি অনেক সরু, একসঙ্গে দুইজন ওঠা যায় না। আর ফুটওভারব্রিজে উঠতে-নামতে সময় বেশি লাগে। মূলত সময় বাঁচাতে নিচ দিয়ে হেঁটে পার হয়েছি।’
এদিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দেখা যায়, সড়ক ছেড়ে ফুটপাতের ওপর দিয়ে গণপরিবহণ চলাচল করছে। এছাড়া মোটরসাইকেল চালকরা একটু বেশি সুবিধা নিতে ফুটপাতেই তুলে দিয়েছেন নিজেদের বাহনটি।
ফুটপাতের ওপর দিয়ে গাড়ি চালানোর কারণ জানতে চাইলে শিকড় পরিবহনের চালক জাহিদ বলেন, ‘আগের গাড়িটা গেছে বলে আমিও পেছন পেছনে আসছি। ভুল হয়ে গেছে।’ ট্রাফিক আইন মানেন না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মানি, মাঝে মধ্যে একটু ভুল হয়ে যায়।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আমরা চেষ্টা করছি। তবে এটা একদিনেও হবে না, ১৫ দিনেও হবে না। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। ধীরে ধীরে এর সফলতা আসবে। এছাড়াও শহরে বিভিন্ন জায়গাতে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে, তাই সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের সব দেশে প্রাইমারি স্কুলে ট্রাফিক এডুকেশন রয়েছে, এরজন্য ট্রাফিক আইন সম্পর্কে তাদের কাউকে বোঝাতে হয় না। তারা সড়কে এলেই নিজে থেকেই আইন মেনে চলাচল করে। আমাদের দেশে এই সংস্কৃতি যেহেতু হয়নি, তাই আমাদের ট্রাফিক সপ্তাহ দিতে হয়, আবার ট্রাফিক সচেতনতা মাসও দিতে হয়।
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পরিবহন মালিক-শ্রমিক, সরকারের বিভিন্ন পক্ষ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সমন্বয জরুরি বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ কার্যক্রমে শুধুমাত্র মামলাই দেওয়া হচ্ছে, এর বেশি কিছু হচ্ছে না। সত্যিকার শৃঙ্খলা ফেরাতে সব পক্ষের সমন্বয় প্রয়োজন, যা আসলে হচ্ছে না। সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ না করলে সড়কে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব নয়।’