মহসিন আজাদ।। বিশ্বব্যাপী ছাড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রোকপ ঠেকাতে মাঠপর্যায়ে কাজ করছে সেনাবাহিনী। রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ময়মনিসংহ, খুলনাসহ বিভিন্ন স্থানে সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা দিতে মাঠে নেমেছেন সেনা সদস্যরা। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে মাইকিং করছেন তারা।
সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে পুরো দেশ চষে বেড়াচ্ছে জেলা প্রশাসন ও সেনাবাহিনী। তবে করোনাভাইরাসের আতঙ্কে এমনিতেই ফাঁকা হয়ে পড়েছে সারা দেশের রাস্তাঘাট। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না। বৃহস্পতিবার (২৬ মার্চ) থেকে সরকার সরাদেশের সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণাও করেছেন।
বৃহস্পতিবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৫ মার্চ থেকে পাঠপর্যায়ে কাজ করছে সেনাবাহিনী। এ পর্যন্ত তারা ২৯০টি দলে ৬১টি জেলায় বিভক্ত হয়েছে করোনা মোকাবিলায়। বর্তমানে সারাদেশে আড়াই হাজারের বেশি সেনাসদস্য এ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। একইসঙ্গে ভাইরাসটি প্রতিরোধে সেনাবাহিনীর এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলেও জানিয়েছে আইএসপিআর।
এ সময়ে সামাজিক দূরত্ব ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সাধারণ জনগণকে উৎসাহিত করেছেন সেনা সদস্যরা। পাশাপাশি তারা বিদেশফেরতদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের বিষয়টিও পর্যবেক্ষণ করেছেন।
সকল প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যি নিচে তুলে ধরা হলোঃ
রাজশাহী: ফাঁকা হয়ে পড়েছে রাজশাহীর রাস্তাঘাট। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না। তবে বৃহস্পতিবার (২৬ মার্চ) সকাল থেকে রাস্তায় নেমেছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে মাইকিং করছেন সেনা সদস্যরা। অন্যদিকে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে পুরো জেলায় চষে বেড়াচ্ছে জেলা প্রশাসনের ২৯টি মোবাইল টিম।
জেলা প্রশাসক মো. হামিদুল হক জানান, একজন মেজরের নেতৃত্বে সকাল থেকে সেনা সদস্যদের একটি টিম মাঠে রয়েছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর হতে বের না হতে ও একজনের থেকে আরেকজনের নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, জনগণকে ঘরে রাখতে অভিযান চলছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে ২৯টি মোবাইল টিম কাজ করছে পুরো জেলায়। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি টহল দিচ্ছে পুলিশ। সকলকে ঘরে নিরাপদ থাকতে ও করোনা সতর্কতায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলারও পরামর্শ দেন জেলা প্রশাসক।
এদিকে একেবারেই জনশূন্য হয়ে পড়েছে নগরী। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও রিকশা ও অটো চলছে সীমিত আকারে। মার্কেট ও দোপানপাটগুলো খোলেনি। তবে খাবার, ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান খোলা রয়েছে। নগরীর রাস্তায় গাড়ির মাধ্যমে জীবানুনাশক ছেটাচ্ছে সিটি কর্পোরেশন।
সংগৃহিত
রংপুর: করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ও জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে আনতে রংপুরে সেনাবাহিনী মাঠে নেমেছে। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে সিটি করপোরেশনসহ ৮ উপজেলায় তারা কাজ শুরু করেছেন। এদিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় রংপুরের ৮ উপজেলায় করোনা প্রতিরোধে হটলাইন চালু করেছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান জানান, লেফটেন্টেন কর্নেল তারেক, মেজর ইমরানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি টিমের সাথে মঙ্গলবার প্রস্তুতি সভা হয়েছে। তারা ৩টি ভাগে ভাগ হয়ে কাজ শুরু করেছেন। এর মধ্যে তারাগঞ্জ-বদরগঞ্জ উপজেলায় একটি, পীরগঞ্জ গঙ্গাচড়ায় একটি এবং বাকি ৪টি উপজেলা ও সিটি করপোরেশনে একটি টিম কাজ করবে।
তিনি জানান, সেনাবাহিনী প্রথমত বিদেশফেরতদের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করবে। জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ এবং ঘোষিত আইসোলেশন সেন্টার এবং ইনস্টিটিউশনাল কোয়ারেন্টান সেন্টার ভিজিটের মাধ্যমে জেলা প্রশাসনের সাথে কাজ করবে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা প্রনণয়ন করে করোনা মহামারী প্রতিরোধে কাজ করবে। সেনাবাহিনীর টিম উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা চেয়ারম্যান, সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বয়ে কাজ করবেন।
এদিকে রংপুরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে জেলার আট উপজেলাতে হটলাইন চালু করেছে জেলা প্রশাসন। সর্দি, কাশিসহ চিকিৎসা বিষয়ক পরামর্শ গ্রহণের হটলাইন এর সহযোগিতা নিতে আহ্বান জানিয়েছে জেলা প্রশাসক। জেলা প্রশাসন এক বিজ্ঞপ্তিতে রংপুরবাসীকে করোনাভাইরাসে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনতা অবলম্বন করাসহ সরকারি নির্দেশনা মেনে চলতে আহবান জানিয়েছেন।
সিলেট: করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলায় সামাজিক সঙ্গ নিরোধ এবং হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। বৃহস্পতিবার (২৬ মার্চ) থেকে সিলেট নগরসহ সিলেট জেলার সর্বত্রই টহল দিতে দেখা যায় সশস্ত্র বাহিনীকে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর লক্ষ্যে সিলেটের সব এলাকায় সামাজিক দূরত্ব ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধার্থে প্রশাসনকে সহায়তায় নিয়োজিত হয়েছে সেনাবাহিনী।
জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সমন্বয়ে তারা জেলা ও বিভাগীয় করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাব্যবস্থা, সন্দেহজনক ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা পর্যালোচনা করবে।
বৃহস্পতিবার সকালে সিলেট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (মিডিয়া) মো. মেজবাহ উদ্দিন বলেন, গত মঙ্গলবার সিলেট বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে এক জরুরি মিটিং হয়। তার পরদিন (বুধবার) থেকেই সেনাবাহিনী প্রস্তুতি নেয়। তবে আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে টহল দিচ্ছে তারা।
সিলেট নগরের বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, আম্বরখানাসহ মহানগরীর বিভিন্ন জায়গায় সেনাবাহিনীকে টহল দিতে ও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া মানুষকে ঘর থেকে বের না হতে পরামর্শ দিতে দেখা যায়।
এদিকে, সেনাবাহিনী ছাড়াও সিলেটে জনসমাগম রোধ করতে পুলিশেরও টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে জানালেন সিলেট মেট্রোপলিটন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া ও কমিউনিটি সার্ভিস) মো. জেদান আল মুসা।
তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সকল বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বিত কার্যক্রমেই আমরা এ পরিস্থিতিটা মোকাবেলা করার চেষ্টা করছি। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি পুলিশও সিলেটে বিশেষভাবে টহল দেবে- যাতে জনসমাগম বৃদ্ধি না করার সরকারি নির্দেশটা কার্যকর হয় এবং সিলেটে ভয়ঙ্কর এই ভাইরাসটার সংক্রমণ না ঘটে।
জেদান আল মুসা আরও বলেন, ইতিপূর্বে এসএমপি’র উদ্যোগে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে মাইকিং করা হয়েছে, আগামীতে আরও করা হবে। এই অবস্থায় কাউকে বাইরে অযথা ভিড় করতে দেখলে বাধ্যতামূলক ঘরে পাঠানো হবে, প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বুধবার রাতে সিলেটের জেলা প্রশাসক (সিলেট ডিসি) ফেসবুক একাউন্ট থেকে এক পোস্টে বলা হয়, আগামীকাল (শুক্রবার) থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ব্যতিত কেউ ঘরের বাইরে বের হবেন না। সকাল থেকে পুলিশ ও সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে।
সংগৃহিত
চট্টগ্রাম: করোনা প্রতিরোধে বিদেশফেরতদের হোম কোয়ারেন্টিন পর্যালোচনার পাশাপাশি লোকজনের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে চট্টগ্রামের সড়ক ও অলি-গলিতে প্রশাসনের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের মতো টহল দিচ্ছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
নগরের অভিযানে হোম কোয়ারেন্টিন না মানায় দুবাইফেরত এক প্রবাসীকে জরিমানার পাশাপাশি বাড়তি মূল্যে স্যানিটাইজার, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির দায়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে ৮৯ হাজার টাকা জরিমানা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।
বৃহস্পতিবার (২৬ মার্চ) চট্টগ্রাম নগরে প্রশাসনের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সদস্যরা সড়ক ও অলিগলিতে টহল দেন। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এতে নেতৃত্ব দেন।
নগরের চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, খুলশী ও বাকলিয়া থানা এলাকায় পরিচালিত অভিযানে নেতৃত্ব দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মামনুন আহমেদ অনিক। অভিযানে তার সঙ্গে ক্যাপ্টেন সালমানের অধীনে সেনাবাহিনীর সদস্যরা অংশ নেন।
ম্যাজিস্ট্রেট মামনুন আহমেদ অনিক জানান, অভিযানে চান্দগাঁও এলাকায় দুবাইফেরত এক প্রবাসী হোম কোয়ারেন্টিন না মানায় ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আন্দরকিল্লায় স্যানিটাইজারের বাড়তি দাম রাখায় একটি প্রতিষ্ঠানকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
নগরের ডবলমুরিং, ইপিজেড, বন্দর ও পতেঙ্গা এলাকায় পরিচালিত অভিযানে নেতৃত্ব দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুজন চন্দ্র রায়। অভিযানে তার সঙ্গে ক্যাপ্টেন মোবিনের অধীনে সেনাবাহিনীর সদস্যরা অংশ নেন।
ম্যাজিস্ট্রেট সুজন চন্দ্র রায় জানান, সম্প্রতি বিদেশফেরতদের হোম কোয়ারেন্টিন পর্যালোচনা, লোকজনকে ঘরের বাইরে না আসার আহ্বানের পাশাপাশি ডবলমুরিং এলাকায় বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি ও মূল্যতালিকা না রাখায় বেকারি, ফাস্ট ফুড এবং ফলের দোকানিকে মোট ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
নগরের চকবাজার, বায়েজিদ, সদরঘাট, এবং কোতোয়ালী থানা এলাকায় পরিচালিত অভিযানে নেতৃত্ব দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শিরীণ আক্তার। অভিযানে তার সঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সদস্যরা অংশ নেন।
ম্যাজিস্ট্রেট শিরীণ আক্তার জানান, অভিযানে সম্প্রতি বিদেশফেরতদের হোম কোয়ারেন্টিন পর্যালোচনা, লোকজনকে ঘরের বাইরে না আসার আহ্বান জানিয়েছি আমরা। এছাড়া হ্যান্ড গ্লাভস ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম না পরে দোকানে আসায় এক মুদি দোকানিকে ৪ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
নগরের পাহাড়তলী, আকবর শাহ এবং হালিশহর থানা এলাকায় পরিচালিত অভিযানে নেতৃত্ব দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা আফরোজ। অভিযানে তার সঙ্গে ক্যাপ্টেন আশিকের অধীনে সেনাবাহিনীর সদস্যরা অংশ নেন।
ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা আফরোজ জানান, লোকজনকে জরিমানার পরিবর্তে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করেছি আমরা। বিদেশফেরতদের হোম কোয়ারেন্টিন মানার পরামর্শসহ ওই এলাকার বাসিন্দাদের জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না আসার অনুরোধ জানিয়েছি।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বদিউল আলম জানান, সম্প্রতি বিদেশফেরতদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার পাশাপাশি লোকজনের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বাজায় রাখতে প্রশাসন ও সেনাবাহিনী কাজ করছে। কেউ সরকারি নির্দেশনা না মানলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বরিশাল: বরিশাল জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এসএম অজিয়র রহমান বলেছেন, আপাতত বরিশালে দুই প্লাটুন সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা কাজ করবেন। এক্ষেত্রে বাজার মনিটরিং, প্রবাসীদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত, মানুষ যাতে বাইরে অযথা ঘোরাফেরা না করতে পারে, সে বিষয়ে তদারকির পাশাপাশি চলমান দুর্যোগের মধ্যে ত্রাণ কার্যক্রমও পরিচালনা করবে সেনাবাহিনী।
ময়মনসিংহ: মোমেনশাহী সেনানিবাস থেকে সকালে ৪ প্লাটুন সেনা সদস্যের গাড়িবহর বের হয়ে নগরীর বিভিন্ন সড়কে টহল দেয়। নগরীর ব্যস্ততম এলাকা গাঙ্গিনারপাড়, স্টেশনরোড, চরপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় জটলা করে থাকা লোকজনকে সরিয়ে দেন সেনাসদস্যরা।