ঢাকা।। সুচিত্রা সেন ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী। এই উপমহাদেশের কোটি কোটি ভক্তের স্বপ্নের নায়িকা ছিলেন তিনি। বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পকে অলংকৃত করেছেন তাঁর অসাধারণ অভিনয়, সৌন্দর্য ও প্রতিভা দিয়ে। বাংলা চলচ্চিত্রের রোমান্টিকধারার অভিনয়ে অনন্য পথিকৃৎ তিনি। কালজয়ী নায়ক উত্তম কুমারের বিপরীতে অভিনয় করে তিনি পেয়েছিলেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা।
সুচিত্রার সততা, নিষ্ঠা, আদর্শবাদিতা একাগ্রতা স্মরণীয় ও শিক্ষণীয়। একজন সফল নায়িকা হিসেবে তিনি জীবনের জয়গান গেয়েছেন সর্বত্র। তাঁর মতো নায়িকা হাজার বছরে একজন জন্মায়। সুচিত্রা সেন তাঁর অভিনয়শৈলী ও দক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন।
আজ ৬ এপ্রিল কীর্তিমান এই মহানায়িকার ৮৯তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৩১ সালের এইদিনে পাবনাস্থ নানাবাড়িতে তিনি জন্মগ্রহন করেন। তখন তার নাম ছিল রমা দাশগুপ্ত। বাংলাদেশের পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনে করুণাময় দাশগুপ্ত আর ইন্দিরা দাশগুপ্তের পরিবারে চোখ মেলে রমা। পাঁচ সন্তানের মধ্যে তৃতীয় কন্যা সন্তান হলেও রমার জন্মে আপ্লুত স্কুল শিক করুণাময় পুরো এলাকার মানুষকে মিষ্টিমুখ করান সেদিন।
শিানুরাগী পরিবারের মেয়ে রমা পাবনার মহাখালী পাঠশালার পাঠ শেষ করে পা দেন পাবনা গার্লস স্কুলে; দশম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই। ১৯৪৭ সালের কথা। ওই দিবানাথ সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় রমার। দিবানাথের মামা বিমল রায় ছিলেন তখনকার খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা। ভাগ্নেবধূ রমাকে তিনিই নিয়ে আসেন রূপালী পর্দায়। রত্ন চিনতে তিনি যে ভুল করেননি, তার প্রমাণ পরের ২৫ বছর ভারতবর্ষের মানুষ পেয়েছে।
রূপালী পর্দায় শুরুটা হয়েছিল ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ ছবির মধ্য দিয়ে। যদিও সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। পরের বছরই মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে জুটি বেধে অভিনয় করা ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ছবিটি তখন বাজিমাত করে। আর পিছনে ফিরতে হয়নি সুচিত্রাকে। শুরু হয় স্বর্ণালী কর্মযজ্ঞের অনবদ্য ইতিহাস।
ভারতীয় অভিনেত্রী হলেও বাংলাদেশেও তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন সুচিত্রা সেন। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন বাংলাদেশি। ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির পাবনা জেলার সদরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আর মা ইন্দিরা দেবী গৃহবধূ। সুচিত্রা ছিলেন পরিবারের পঞ্চম সন্তান ও তৃতীয় কন্যা। পড়াশোনাও করেছিলেন এই পাবনা শহরেই।
১৯৪৭ সালে বিশিষ্ট শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথ সেনের সঙ্গে সুচিত্রা সেনের বিয়ে হয়। তাঁর একমাত্র কন্যা মুনমুন সেনও ভারতের একজন খ্যাতনামা অভিনেত্রী। সুচিত্রা সেনের অভিনয় জগতের পথচলা শুরু হয় ১৯৫২ সালে। তাঁর অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ‘শেষ কোথায়’।
উত্তম কুমারের বিপরীতে তিনি প্রথম অভিনয় করেন ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে। ছবিটি বক্স-অফিসে সাফল্য লাভ করে। ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় উত্তম-সুচিত্রা জুটিও। তারপর থেকে বাংলা ছবি মানেই ছিল উত্তম-সুচিত্রা। উত্তম কুমারের সাথে বাংলা ছবিতে রোমান্টিকতা সৃষ্টি করার জন্য তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বিখ্যাত অভিনেত্রী। বাংলা ছবির এই অবিসংবাদিত জুটি পরবর্তী ২০ বছরে ছিলেন আইকনের মত।
সুচিত্রা সেন হিন্দি ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন ১৯৫৫ সালে। ‘দেবদাস’-এর মতো বিখ্যাত সিনেমা দিয়েই তাঁর বলিউডে যাত্রা শুরু হয়েছিল। প্রথম ছবিতেই জিতে নিয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার। ক্যারিয়ারে মোট চারটি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছিলেন তিনি। তার অনবদ্য অভিনয় এবং অপরূপ সৌন্দর্য আজও দাগ কেটে আছে কোটি দর্শকের হৃদয়ে।
১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন ‘সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস’ অর্জন করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। এর পর ১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে। ২৫ বছর সুনামের সঙ্গে অভিনয়ের পর ১৯৭৮ সালে চলচ্চিত্রকে বিদায় জানান সুচিত্রা।
হিন্দি চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রতিবছরই দাদাসাহেব সম্মাননা প্রদান করে ভারত সরকার। অবসরের প্রায় ২৭ বছর পর ২০০৫ সালে এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। কিন্তু দিল্লি গিয়ে ভারতের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে সশরীরে পুরস্কার নিতে তিনি আপত্তি জানিয়েছিলেন। যার কারণে পুরস্কারটি পাওয়া হয়নি তাঁর।
চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে বঙ্গ-বিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত করেছিল। সেসময় মেয়ে মুনমুন সেন তার মায়ের হয়ে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন। সুচিত্রা সেন ১৯৭৮ সালে প্রণয় পাশা ছবি করার পর লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। মহানায়ক উত্তম কুমার-এর মৃত্যুর পর সুচিত্রা তাকে ফুল দিতে যান। এরপর থেকে তিনি আর জনসমক্ষে আসেননি। মাঝে একবার ভোটার পরিচয়পত্রের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে ছবি তুলতে ভোটকেন্দ্রে যান। সুচিত্রা সেন ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভক্ত। একবার তিনি গোপনে কলকাতা বইমেলায় গিয়েছিলেন।
বলিউড-টালিউডের বহু পরিচালক সুচিত্রা সেনকে নিয়ে ছবি করতে চাইলেও তিনি এতে সম্মত হননি। এমনকি দেশ-বিদেশের কোনো পরিচালক বা অভিনেতা বা অভিনেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎও দেননি তিনি। সেই থেকে তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যান। যদিও তার বাসভবনে তিনি কেবল কথা বলেছেন তার একমাত্র মেয়ে মুনমুন সেন এবং দুই নাতনি রিয়া ও রাইমার সঙ্গে।
তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে-অগ্নিপরীক্ষা, মরণের পরে, দেবদাস, মেজ বউ, সাগরিকা, পাপমোচন, শিল্পী, মুশাফির, রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত, দ্বীপ জ্বেলে যাই, চাওয়া পাওয়া, বোম্বাই কা বাবু, সাত পাকে বাঁধা, উত্তর ফাল্গুনী, হার মানা হার ও প্রণয়পাশা প্রমুখ।
আ/রি