ঢাকা।। আর মাত্র ২৪ মিনিট পার করতে পারলেই অবিশ্বাস্য ড্র-এ বড় কিছু অর্জন করতে পারতো বাংলাদেশ। তবে ৩২ বল যখন বাকি, তখন শেষ প্রতিরোধ থেমে যায়।
তাইজুলকে এলবিডাব্লুউতে ফিরিয়ে দিয়ে ইনিংস এবং ৮ রানে জিতে শতভাগ সাফল্যে বাংলাদেশ সফর শেষ করলো পাকিস্তান। টি-২০ সিরিজে ৩-০তে জয়ের পর ২-০তে টেস্ট সিরিজ জিতলো বাবর আজমের দল।
আম্পায়ার ঘড়ি দেখে যখন এক ঘন্টা অবশিস্ট বলে জানিয়ে দিয়েছেন, তখন মিউচ্যুয়াল ডিক্লেয়ারেশনের দিকে ধাবিত হচ্ছে ম্যাচটা, এমনটাই কেউ কেউ ধরে নিয়েছে। এক ঘন্টায় পার করতে হবে ১৫ ওভার, সাকিব-মিরাজকে ঘিরে ম্যাচ বাঁচানোর সম্ভাবনা দেখেছে অনেকে। প্রেস বক্সে খেলা দেখতে আসা পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা সৃজিত মুখোপাধ্যয়ও ম্যাচটার গন্তব্য ড্র, এমন ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন।
অথচ, পরের ওভারটাই বিপদ ডেকে আনলেন মিরাজ। জীবনে প্রথম টেস্টে বল করেছেন বাবর আজম মঙ্গলবার। বাংলাদেশ দলকে নিয়ে হাস্যরস করতে ১ ওভারের ওই স্পেলে দেখেছেন বাংলাদেল ব্যাটারদের দুর্বলতা। বুধবার পুনরায় বল হাতে নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম উইকেটের মুখটা দেখেছেন বাবর আজম।
মিরাজকে এলবিডাব্লুতে ফিরিয়ে দিয়ে (১৪) ৫১ রানের পার্টনারশিপটি শুধু বিচ্ছিন্নই করেননি, মিরাজের ওই আউটটাই বাংলাদেশকে ম্যাচ থেকে ছিটকে ফেলেছে। পরের ওভারে সাজিদকে ব্যাকফুটে খেলতে যেয়ে সাকিব বোল্ড আউট হলে (১৩০ বলে ৯ চার এ ৬৩) ড্র-এর আশা শেষ হয়ে যায়! অবশিস্ট প্রতিরোধ গড়তে পারেননি খালিদ, তাইজুল, এবাদতরা।
প্রথম চারদিনের বৈরী আবহাওয়ার ছিটে-ফোটা ছিল না পঞ্চম দিনে। সকাল থেকেই হেসেছে সূর্য। প্রাকৃতিক আলোয় আলোকিত মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়াম।অথচ, ক্রিকেটিয় এই আবহাওয়াই উল্টো বাংলাদেশ ব্যাটারদের ফেলেছে অস্বস্তিতে!
দিনের প্রথম দুই সেশনের ব্যাটিং বিপর্যয়ে ইনিংস হারের শঙ্কায় পড়েছে বাংলাদেশ দল। এই সেশনে বাংলাদেশ দুই ইনিংস মিলে ১৫৮ রান যোগ করতে হারিয়েছে ৯ উইকেট ! টি ব্রেক পর্যন্ত বাংলাদেশের স্কোর দ্বিতীয় ইনিংসে ১৪৭/৬। ইনিংস হার এড়াতে তখনও বাংলাদেশের দরকার ৬৭ রান। ম্যাচ বাঁচাতে বাংলাদেশকে পাড়ি দিতে হবে শেষ সেশন।
দুর্যোগপূর্ণ দিনের শুরুটা প্রথম ২৮ মিনিটেই। ১১ রান যোগ করতে প্রথম ইনিংসের শেষ ৩ উইকেট হারিয়েছে বাংলাদেশ। পর পরের ৩ ঘন্টা ২২ মিনিটে ১৪৭ রানে নেই ৬ ব্যাটার !
বৈরী আবহাওয়ায় সোয়া দুই দিন খেয়ে ফেলার পর ম্যাচ বাঁচানোটা সহজ মনে করাই স্বাভাবিক। অথচ ফলো অন এড়াতে দরকার যখন মাত্র ১০১ রান, এই লক্ষ্যটাই পেরুতে পারেনি বাংলাদেশ দল!
চতুর্থ দিন শেষে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৭৬/৭, সেখান থেকে পঞ্চম দিনে শেষ তিন জুটির টার্গেট ছিল ২৫ রান। এটাই কি না দূরুহ হয়ে পড়লো ! ৫ম দিনে ১১ রান যোগ করতে বাংলাদেশ হারিয়েছে শেষ ৩ উইকেট। ঘরের মাঠে ২০০২ সালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে জেরিমি লসনের একটা ভয়ংকর স্পেলে (৬.৫-৪-৩-৬) ৮৭ রানে অল আউট হওয়া ছিল এতোদিন সর্বনিম্ন স্কোর। সেই সর্বনিন্ম স্কোরকে স্পর্শ করেছে বাংলাদেশ মিরপুরে।
পাকিস্তানের বিপক্ষে ইতোপূর্বে সর্বনিম্ন স্কোর ছিল ৯৬। ২০০৩ সালে পেশোয়ারের সেই স্কোরের লজ্জাকেও ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিপক্ষে সর্বনিম্ন স্কোরের লজ্জাটা (৮৭/১০) এদিন পেয়েছে বাংলাদেশ। ১৪ রানের জন্য ফলো অন এড়াতে ব্যর্থ বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসেও ব্যাটিং বিপর্যয়ের কবলে। ইনিংস হার এড়ানোর জন্য দ্বিতীয় ইনিংসে ২১৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে লাঞ্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্কোর ৭২/৪।
অফ স্পিনার সাজিদের আতঙ্ক ছড়ানো বোলিংয়ে (১৫-৪-৪২-৮) প্রথম ইনিংসে ছিন্ন-ভিন্ন হয়েছে বাংলাদেশ। চতুর্থ দিন তার একটা স্পেলেই (১২-৩-৩৫-৬) সর্বনাশ হয়েছে বাংলাদেশের ( ৭৬/৭) ! ৫ম দিনে ২৮ মিনিটের ইনিংসেও ১১রানে শেষ ৩ উইকেট উড়ে যাওয়ায়ও আতঙ্কের নাম সাজিদ (৩-১-৭-২)।
নিজের ক্যারিয়ার সেরা বোলিং ইনিংসটি পাকিস্তানের ৪র্থ সেরা। কাদির (৯/৫৬), সরফরাজ (৯/৮৬), ইয়াসির শাহ (৮/৪১)-এর পেছনে (৮/৪২) ঠাঁই পাওয়া সাজিদ বাংলাদেশের বিপক্ষে যে কোন বোলারের মধ্যে সেরা বোলিং করেছেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে ইনিংসে ৮ উইকেটের দৃষ্টান্দ ছিল এতোদিন শুধুই অজি স্পিনার স্টুয়ার্ট মাকগিলের। ২০০৬ সালে ফতুল্লায় তার বোলিং (৩৩.৩-৩-১০৮-৮) ছাড়িয়ে গেছেন সাজিদ ( ১৫-৪-৪২-৮)। ৫ম দিন সকালে হেসেছে সূর্য, তাতে হাসিটা চওড়া হয়েছে পাকিস্তানের।
দিনের ১২তম ডেলিভারিতে সাজিদের বলে তাইজুল এলবিডাব্লু (১৬ বলে ০)। দিনের ১৫তম বলে শাহিন শাহ আফ্রিদির বলে বোল্ড খালেদ (২ বলে ০)। আগের দিন ২৩ রানে ব্যাটিংয়ে থাকা সাকিব থেমেছেন ৩৩ রানে, নিজের উপর বিরক্ত হয়ে! সাজিদ খানকে এক্সট্র্রা কভারে বাউন্ডারি মেরে পরের বলকেও দিতে চেয়েছিলেন সাজা। হাফ পিচে এসে খেলতে যেয়ে শর্ট কভারে দিয়েছেন ক্যাচ (৫৪ বলে ৪ চার-এ ৩৩)। ৩ ওভারের স্পেলে (৩-২-৩-১) এই একটি শিকার শাহিন শাহ আফ্রিদির।
প্রথম ইনিংসের ব্যর্থতা দ্বিতীয় ইনিংসেও আচ্ছন্ন করেছে বাংলাদেশ দলকে। ইনিংস হার এড়ানোর জন্য ২১৪ রানের কাজটা দূরুহ হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের। মেঘলা আবহাওয়ায় বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস ছিন্ন-ভিন্ন করা অফ স্পিনার সাজিদ খানকে দিয়ে নয়, দিনের প্রথম ঘন্টায় বাংলাদেশের টপ অর্ডারে আতঙ্কে ফেলেছেন পাকিস্তানের পেস জুটি শাহিন শাহ আফ্রিদি (৫-২-১০-২) ও হাসান আলী (৫-২-১২-২) তাদের এক স্পেলে। টেস্ট ডেব্যুটেন্ট মাহমুদুল হাসান জয় প্রথম ইনিংসে ০-এর পর দ্বিতীয় ইনিংসে থেমেছেন ৬ রানে।
বাংলাদেশের ইনিংসের ১৩তম মিনিটে হাসান আলীকে ডিফেন্স করতে যেয়ে বোল্ড তিনি (৬)। খেলার ১৮তম মিনিটে শাহিন আফ্রিদির বলে পরিস্কার এলবিডাব্লু সাদমান (২)। ৩০ মিনিটের মাথায় হাসান আলীর বলে মুমিনুল এলবিডাব্লুউ (৭)। ৪৪তম মিনিটে শাহিন আফ্রিদির এক্সট্রা বাউন্সে খেলতে যেয়ে গালিতে ক্যাচ দিয়েছেন শান্ত (৬)।
পাকিস্তানের পেস জুটিকে বিশ্রাম দেয়ায় লাঞ্চের আগের ঘন্টা মুশফিক-লিটন ভালভাবেই দিয়েছেন সামাল। সাজিদকে মিড অফ দিয়ে পর পর দুই বলে ২টি বাউন্ডারিতে লিটন জানিয়ে দিয়েছেন ভয়ের কিছুই নেই। অথচ ৭৩ রানে পার্টনারশিপটা বিচ্ছিন্ন হয়েছে লিটনের ভুল শট সিলেকশনে। অফ স্পিনার সাজিদ খানের শর্ট বলে পুল করতে যেয়ে স্কোয়ার লেগে ক্যাচ প্র্যাকটিস করে এসেছেন লিটন (৮১ বলে ৭ চার এ ৪৫ রান)।
টি ব্রেকের ঠিক পূর্বক্ষণে নোমান আলীকে সাকিব স্কোয়ার লেগে খেলে সিঙ্গলের দৌড় দিয়েছিলেন মুশফিক। কিন্তু ব্যাটটা প্লেস করতে পারেননি। ২ রানের জন্য মিস করেছেন মুশফিক ফিফটি ( ১৩৬ বলে ৩ চার-এ ৪৮)। ৪৯ রানে ৬ষ্ঠ উইকেট জুটি বিচ্ছিন্ন হয়েই চাপে ফেলে দিয়েছে টেল এন্ডারদের। হাসান আলীকে পর পর ৩টি বাউন্ডারিতে টি ব্রেকের সময়ে ২৫ রানে ব্যাটিংয়ে থাকা সাকিবে দিতে হচ্ছে বড় পরীক্ষা।
৬ষ্ঠ উইকেট জুটিতে ৪৯, ৭ম উইকেট জুটিতে ৫১ রানে নেতৃত্ব দেয়া সাকিব এদিন বাংলাদেশের তৃতীয় ব্যাটার হিসেবে টেস্টে ৪ হাজারী ক্লাবের সদস্যপদ পেয়েছেন। ২শ’ উইকেটের পাশে ৪ হাজার রান-অলরাউন্ড পারফরমেন্সে সোবার্স, বোথাম, কপিল দেব, ক্যালিসকে ছুঁয়ে ম্যাচ বাঁচানোর প্রানান্ত চেষ্টা করেছেন সাকিব এদিন। তবে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের হত্যাকারী অফ স্পিনার সাজিদ খান (৮/৪২) দ্বিতীয় ইনিংসেও আতঙ্ক ছড়ানোয় (৪/৮৬) সাকিবের একার পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। তার শেষ স্পেলটাই (১০.৪-৫-৮-৩) বাংলাদেশকে ইনিংস হার এড়াতে দেয়নি।