ভূমিকাঃ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘাত চললেও ২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে শুরু হওয়া গাজায় ইসরায়েলের অভিযানের ভয়াবহতা এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।
শিশু,নারী,বেসামরিক নাগরিক, এমনকি ত্রাণকর্মীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে ইসরায়েল যা করছে তা কেবল যুদ্ধ নয়,বরং একটি জাতিগত নিধনযজ্ঞ (genocide) বলেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো একে অভিহিত করছে। আন্তর্জাতিক আইন,মানবিকতা ও সংবেদনশীলতার সকল সীমা বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে,অথচ বিশ্ব রাজনীতি যেন গভীর ঘুমে।
নির্মম বাস্তবতা: গাজা এখন মৃত্যুপুরী
জাতিসংঘ ও অন্যান্য নিরপেক্ষ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সাল নাগাদ গাজার প্রায় ৯৭ শতাংশ এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে,পানীয় জল এবং খাদ্য সরবরাহ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত। ইসরায়েলি বোমা হামলায় মসজিদ,গির্জা,হাসপাতাল,শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি জাতিসংঘ পরিচালিত আশ্রয়কেন্দ্র পর্যন্ত ধ্বংস হয়েছে। রেডক্রস ও অন্যান্য মানবিক ও ত্রান সংস্থা জানায়, চলমান সহিংসতায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজারের বেশি ত্রাণকর্মী ও বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন, যার একটি বড় অংশ শিশু ও নারী।
নেতানিয়াহুর নীতি: ক্ষমতার লোভ না গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা?
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কেবল হামাস বিরোধিতার অজুহাতে গাজার নিরীহ জনগণের ওপর ভয়াবহ নিপীড়ন চালাচ্ছেন বলে বিশ্লেষকদের দাবি। অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি মামলা ও রাজনৈতিক চাপে থাকা নেতানিয়াহুর জন্য এই যুদ্ধ এক প্রকার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ইসরায়েলের ভেতরেই এক বড় জনগোষ্ঠী যুদ্ধ বিরোধী সমাবেশ করছে এবং যুদ্ধ থামানোর দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে।
বিশ্বের প্রতিক্রিয়া: নীরবতা, দ্বিমুখিতা ও কূটনৈতিক বাণিজ্যঃ
বর্তমানে বিশ্বের ১৩৫টিরও বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্পেন,আয়ারল্যান্ড,
নরওয়ে,স্লোভেনিয়া সহ একাধিক ইউরোপীয় দেশ ফিলিস্তিনের পক্ষ নিয়ে সরব হয়েছে। বে,যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সবচেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ।মানবাধিকার,গণতন্ত্র ও শান্তির কথা বললেও আমেরিকা একদিকে প্রকাশ্যে,অন্যদিকে গোপনে ইসরায়েলকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি দেখা গেছে,অস্ত্রবিরতির প্রস্তাবে বারবার ভেটো প্রয়োগ করে ইসরায়েলকে সময় ও সুযোগ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এছাড়া ফিলিস্তিনের বেদনার ক্ষততে আরব দেশগুলো ভবিষ্যতের স্বাধিকার আন্দোলনের টোপ ব্যবহার করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে যাচ্ছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোর নীরবতা ও কৌশলগত ব্যবসায়িক চুক্তিগুলো মুসলিম ঐক্যকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
মুসলিম বিশ্বের ভঙ্গুর প্রতিক্রিয়া ও আভ্যন্তরীণ বিভাজনঃ
মুসলিম বিশ্ব এই ইস্যুতে যেমন ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি, তেমনি ফিলিস্তিন ইস্যুতে কার্যকর কোনো রাজনৈতিক বা সামরিক চাপ সৃষ্টি করতেও ব্যর্থ। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ নিজেদের ভিন্নমত,ক্ষমতা রাজনীতি,এবং আন্তর্জাতিক চুক্তির স্বার্থে নীরব দর্শকের ভূমিকায় রয়ে গেছে।
দুই রাষ্ট্র সমাধান: বিকল্প নেই৷
ফিলিস্তিন সংকটের স্থায়ী ও টেকসই সমাধান হলো “দুই রাষ্ট্র সমাধান” (Two-State Solution)। এই প্রস্তাব অনুযায়ী,ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন দুটি স্বাধীন ও সমান সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে সহাবস্থান করবে। কিন্তু এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ইসরায়েলের দখলদার নীতি এবং আন্তর্জাতিক শক্তির দ্বিমুখিতা। যদি বিশ্ব সম্প্রদায় এই সমাধান বাস্তবায়নে আন্তরিক না হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে সহিংসতা দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং শুধু ফিলিস্তিন নয়,ইসরায়েল ও তার মিত্ররাও ভবিষ্যতে বিপদে পড়বে-এমন সতর্কবার্তা বহু বিশ্লেষক দিয়ে যাচ্ছেন।
উপসংহার: মানবতার পক্ষ নেয়া এখন সময়ের দাবিঃ-
মানবতা, ন্যায়বিচার এবং আন্তর্জাতিক নীতি নৈতিকতার স্বার্থে এখন সময় এসেছে স্পষ্ট ও কার্যকর অবস্থান নেয়ার। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা কেবল একটি রাজনৈতিক দাবি নয়-এটি মানবিক অস্তিত্বের লড়াই। জাতিগত নিধনের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এই জাতির জন্য নীরব থাকা মানে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে,কে মানবতার পাশে ছিল,আর কে ছিল ক্ষমতার মোহে অন্ধ।
✍ মীর রেজাউল হোসেন-পরিচিতি: কবি ও লেখক