জাফর আলম,কক্সবাজার।।
কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের টেকনাফ হোয়াইক্যং রেঞ্জের চারটি বনবিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চল প্রায়ই অরক্ষিত হয়ে পড়েছে।সরকারী বনভুমিতে সৃজিত অংশীদারি বনায়নের মুল্যবান কাঠ পাচারের মহোৎসব চলছে।বনের বিপুল গাছ সাবাড় করে বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন খোদ রেঞ্জ অফিসার আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট চক্র।
বিগত সময়ে বনের প্রায় গাছ নিধন করায় সরকার ও গরীব উপকারভোগীরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্হ হয়।বর্তমানে নির্বিচারে সংরক্ষিত বনের কাঠ উজার অব্যাহত রয়েছে।বনে সৃজিত শত শত কোটি টাকার কাঠ হরিলুট হচ্ছে।সেই সাথে পাহাড় বিক্রি ও পাহাড় কাটা কাজেও সহযোগীতা দিচ্ছে বলে অভিযোগ।অবৈধ স’মিল ও নৌকার মালিক থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদাবাজি করছে এই রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল মতিন।এছাড়াও টেককনাফে দায়িত্বরত অসাধু বনপ্রহরী, উপকারভোগী,কাঠ ব্যবসায়ী ও কাঠ চোর সিন্ডিকেট বনের মুল্যবান কাঠ পাচারে জড়িত বলে জানাগেছে। হোয়াইক্যং রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল মতিনের বিভিন্ন অনিয়ম দূর্নীতি নিয়ে ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সহ ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন সদস্য।এমনকি তার অধিনস্থদের সাথে সমন্বয়হীনতার কারণে তাদের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ বিরাজ করছে।ভেঙ্গে পড়েছে বনকর্মীদের চেইন অব কমান্ড।খোঁজ নিয়ে ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রেঞ্জ অফিসার আব্দুল মতিন চলতি বছর ১ মার্চ হোয়াইক্যং রেঞ্জে যোগদান করেন।তখন থেকে তার অফিস ও কার্যক্রমকে অনিয়ম ও দূর্ণীতির আখড়ায় পরিণত করেন।জবর দখলকারীদের সাথে যোগসাজস করে মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি।অফিসের নিয়ম নীতিও তেমন তোয়াক্কা করেন না ওই কর্মকর্তা।টাকা না পেলে লোকজনকে ধরে নিয়ে বন আইনে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে আদালতে সোপর্দ করেন।এধরনের মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে অনেক নিরীহ মানুষ কারান্তরিন।
অনুসন্ধানে জানা যায়,বিগত বিভিন্ন সময়ে টেকনাফের বিস্তীর্ণ সরকারী বন ভুমিতে সৃজন করা হয় ১০ বছর মেয়াদী অংশীদারিত্ব বনায়ন।গত ২০০১ সাল হতে হতে বনে পৃথক বন সৃজন প্রকল্প শুরু হয়।বিভিন্ন স্থানে সৃজিত বনে মেয়াদপুর্ণ হতে চলছে।আবার বিভিন্ন স্থানে ৩, ৪, ৫, ৬ ও ৭ বছর পূর্ণ হওয়া বন সবুজ সমারোহে ভরে উঠে।এসব বনের বিপুল গাছ নিধন করায় সরকার ও গরীব উপকারভোগীরা সুফল বঞ্চিত হচ্ছে। টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং, হ্নীলা, বাহারছড়া ও টেকনাফ সদর ইউনিয়নে তৎপর অসাধু সিন্ডিকেট সদস্যরা বনের মুল্যবান কাঠ উজাড় করে পাচার করছে। বনের গাছ উজাড় চিত্র একই হলেও সিন্ডিকেট চক্রের মধ্যে আলাদা আলাদা ভাগ রয়েছে।স্হানীয়রা জানান,হাত করাত,ছিও করাত লম্বা করাত ধারালো দা আর রশি হাতে প্রতিদিন ভোরে কাঠ চোররা বনে প্রবেশ করে বড় বড় আকারের গাছ কেটে তা ছাটায় করে সন্ধ্যায় কাঁধে বহন করে নিয়ে আসে নিজেদের গন্তব্যে।তাছাড়া সন্ধ্যার পর পালাবদল করে উজারকারী দলের সদস্যরা প্রতিনিয়ত বন উজাড় করে থাকে।৩০-৪০জনের সদস্যদের দল একাজে হার হামেশা লিপ্ত।চোরাই কাঠগুলো চিরাই করা হচ্ছে অবৈধ স’মিলে।বনের গাছ উজারকারীরা অসাধু কাঠ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে কাজ করে বাহারছড়াসহ বিভিন্ন স্থানে চোরাই কাঠ দিয়ে ছোট বড় ফিশিং বোট তৈরি হচ্ছে। এসব অবৈধ বোট মালিক থেকেও মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই কর্মকর্তা।
হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উনছিপ্রাং রইক্ষ্যং শামলাপুর বিটসহ বিভিন্ন এলাকার সরেজমিনে গিয়ে জানাযায়,বনের দিবারাত্রি বনে প্রবশ করে কাঠ চোরের দল মুল্যবান কাঠ উজাড় করছে।এছাড়া রইক্ষ্যং বিটের অধীনে ৬০ ও ৪০ হেক্টরের সামাজিক বনায়নে থিনিং এর নামে হাজার হাজার গাছ কেটে পাচার করা হয়।বন কাটার অনুমতি পত্রের নিয়মের বাইরে রইক্ষ্যং বিট,হোয়াইক্যং বিট,মনখালী, মনতলিয়া (শামলাপুর) বনবিটের মুল্যবান গাছ উজাড় করে ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে কাঠ পাচার করে লাখ লাখ টাকা কামাই করছে অসাধু সিন্ডিকেট সদস্যরা ও হোয়াইক্যং রেঞ্জ কর্মকর্তা।
স্থানীয়রা জানান,শুধু টেকনাফ নয়,সারা দেশেই বন বিভাগের জমিতে কম-বেশী অসহায় ভুমিহীন মানুষ বসবাস করে আসছে। অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিও বন বিভাগের জমি দখলে আছে।অথচ টেকনাফের বিভিন্ন স্থানে বর্তমানে বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে হাজার হাজার মানুষ বসবাস করছে,রেঞ্জ অফিসার আব্দুল মতিন তাদের কাছ থেকেও উঠাচ্ছে চাঁদা।যখন তখন রেঞ্জ অফিস বন্ধ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যান তিনি।তার এ নিরুদ্দেশ বনাঞ্চল উন্নয়নে চরমভাবে বিঘ্ন ঘটছে।বাগানের উন্নয়নমূলক কাজে শ্রমিকদের মজুরির টাকা ঠিকমতো প্রদান করা হচ্ছেনা বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী শ্রমিকরা।রেঞ্জ অফিসার আব্দুল মতিন যোগদান করার পরে অবৈধ স’মিলের সংখ্যা (চোরাই কাঠ ছিড়ার যন্ত্র) বেড়ে গেছে।অনেক স’মিল থেকে মাসোয়ারা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।চলতি বছরের ৮ এপ্রিল তৎকালীন টেকনাফের সহকারী কমিশনার ভুমি(এসিল্যান্ড) বর্তমান রামু উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা প্রণয় চাকমার নেতৃত্বে এসময় জব্দ করা হয় চোরাই কাঠ দিয়ে তৈরি করা ২টি ফিশিং বোট, হ্নীলা ও মধ্যম হ্নীলা সাতঘরিয়োপাড়ায় থেকে অবৈধ দুটি স’মিল, বাহারছড়া শামলাপুর থেকে অবৈধ ৪টি স’মিলের যন্ত্রাংশ,চোরাই কাঠ ভর্তি দুটি পিকআপ জব্দ করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, মালিকদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি।পরবর্তীতে ওই রেঞ্জ অফিসার আব্দুল মতিন স’মিলগুলোর মালিকদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে মালিকদের ফেরত দেয় স’মিলে যন্ত্রাংশ। জনশ্রুতি রয়েছে মামলা থেকে বিরত ও স’মিল ফেরত দিয়ে কয়েক লাখ হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। তবে এ ব্যাপারে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা হুমায়ূন কবির জানিয়েছেন, ওই স’মিলগুলো জরিমানা করা হয়েছিল। কিন্তু সচেতন মহলের প্রশ্ন এখনো ওই স’গুলো পুনরায় স্থাপন করে প্রতিদিন হাজার ঘনফুট বনের কাঠ চিরাই করা হচ্ছে।রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।সহ ব্যবস্থাপনা কমিটির আওতায় একাধিক সিপিজি সদস্য জানান,তিনি যোগদান করার পর থেকে বনের উন্নতির পরিবর্তে অবনতি হয়েছে। সম্প্রতি কেরুনতলী এলাকায় পাহাড় কেটে ১৬ একরেরও বেশি চাষাবাদের জমি তৈরি করেছে চিহ্নিত বন খেকোরা।সেই সাথে বড়ছড়া নাম খালে বড় বড় দুইটি বিশালাকারে বাঁধ নির্মাণ করেছে।যা পাহাড়কে চরমভাবে ধ্বংস করে চলছে।এ ব্যাপারে তড়িত ব্যবস্থা নিতে গিয়ে হোয়াইক্যং বিট অফিস বাঁধের আংশিক কেটে দেয় বলে জানা যায়।নাম না প্রকাশ করার শর্তে সিপিজির এক সভাপতি জানান,রেঞ্জ অফিসার আব্দুল মতিন ওই বন খেকোদের সাথে বসে ২ লাখ টাকার বিনিময়ে অভিযান চালানো হবে না বলে আশ্বস্থ করেছেন।যা লোকজনের মুখে মুখে রয়েছে বলেও জানান তিনি।সিপিজির একজন সক্রিয় সদস্য বলেন, সংরক্ষিত বনাঞ্চলে অবৈধ স্থাপনাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা বিপরীতে উৎসাহিত করছে রেঞ্জ অফিসার আব্দুল মতিন।বিট কর্মকর্তা সৈয়দ আশিক আহমদ প্রশাসন ও সিপিজি,সহ ব্যবস্থাপনা কমিটির লোকজনদের সাথে নিয়ে সম্প্রতি বেশ কিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেন।অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার দায়ে এই বিট অফিসারকে বদলি করার তৎপরতা চালাচ্ছে বলেও জানান তিনি।কারণ হিসেবে একাধিক সুত্র বলেছে,ওই সব অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের সময় রেঞ্জ অফিসার মোটা অংকের সুবিধা নিয়েছে।এব্যাপারে অভিযুক্ত রেঞ্জ অফিসার আব্দুল মতিনের বক্তব্য নেওয়ার জন্য তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে একাধিকবার রিং করার পরেও তিনি রিসিভ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।